...আমাদের ওয়েবসাইটে আপনাকে স্বাগতম___ওয়েবসাইটটি ভিজিট করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ...

১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিশ্লেষণ কর

অথবা, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বর্ণনা কর।

অথবা, ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক নির্বাচনের প্রভাব আলোচনা কর।

উত্তর: ভূমিকা: ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচন ও এ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের মহাবিজয় লাভ ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক একাধিপত্যের বিরুদ্ধে পূর্ববাংলার জনসাধারণের অধিকার আদায়ের এক বলিষ্ঠ রাজনৈতিক প্রতিবাদ। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে স্ফুরণ ঘটে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের নিরঙ্কুশ বিজয়ের মধ্য দিয়ে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে । প্রচলিত সংবিধান অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন ১৯৫১ সালে অনুষ্ঠানের কথা থাকলেও তা যথাসময়ে না হয়ে ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচন ছিল পূর্ববাংলার প্রথম প্রাদেশিক নির্বাচন ।

যুক্তফ্রন্ট গঠন: ১৯৪৭ সালের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী সৃষ্ট পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অধীনে পূর্ববাংলার জনগণ তাদের স্বাধীন সত্তা বিকাশের যে আশা করেছিল তা ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের স্বৈরাচারী মনোভাবের কারণে তিরোহিত হয় । স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকে পূর্ববাংলার জনগণ আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে বৈষম্য ও নির্যাতনের সম্মুখীন হয়। এ সচেতনতাবোধ থেকেই ১৯৫৪ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ভেদাভেদ ও মতানৈক্য ভুলে ঐক্যের প্রয়োজন অনুভব করে। এ প্রয়োজনকে সামনে রেখে আসন্ন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে পরাজিত করার উদগ্র বাসনায় আওয়ামী লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলাম ও গণতন্ত্রী দলের সমন্বয়ে ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর একটি সম্মিলিত ঐক্যজোট গড়ে উঠে যা ‘যুক্তফ্রন্ট’ নামে পরিচিত ।

নির্বাচনের প্রভাব/ফলাফল/গুরুত্ব: যদিও যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার কার্যকাল বেশিদিন স্থায়ী হয় নি তবুও নির্বাচনের বিজয় পূর্ববাংলার জনজীবনে এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখতে সক্ষম হয়। এ নির্বাচনের প্রভাব বা ফলাফল ছিল নিম্নরূপ:

১. মুসলিম লীগের একচেটিয়া কর্তৃত্ব হ্রাস: যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের ফলে মুসলিম লীগের এতদিনের একচেটিয়া কৰ্তৃত্ব হ্রাস পায় । পাকিস্তান গণপরিষদের মুসলিম লীগ দলীয় বাঙালি সদস্যরা পূর্ববাংলার জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার হারায়।

২. আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রতি ঐক্যবদ্ধ সমর্থন:  এ নির্বাচনে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকারের দাবির প্রতি পূর্ববাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ঐক্যবদ্ধ সমর্থনের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ।

৩. গণপরিষদে যুক্তফ্রন্টের প্রতিনিধিত্ব : এ নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্ট সংবিধান প্রণয়নে অংশগ্রহণের দাবি জানায় এবং এর ভিত্তিতেই যুক্তফ্রন্টের সমর্থিত সদস্যরা পূর্ববাংলার প্রতিনিধিরূপে দ্বিতীয় গণপরিষদে নির্বাচিত হন ।

৪. বিরোধী দলের বিকাশ: যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পর থেকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে সরকার বিরোধী যথার্থ বিরোধী রাজনৈতিক দলের বিকাশ ঘটে ।

৫. রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি: এ বিজয়ের ফলে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষারূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয় ।

৬. পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের নীতি : এ বিজয়ের ফলে পরবর্তীতে সাংবিধানিকভাবে পূর্ণ আঞ্চলিক

স্বায়ত্তশাসনের নীতি গৃহীত হয় ।

৭. ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির বিকাশ : মুসলিম লীগকে প্রত্যাখ্যান করার মধ্য দিয়ে পূর্ববাংলায় ক্রমান্বয়ে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল ও রাজনীতির বিকাশ ত্বরান্বিত হয় ।

৮. স্বতন্ত্র জাতিসত্তার বিকাশ : যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির সচেতনতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায় । পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে নিজেদের অধিকার আদায়ে তারা ক্রমান্বয়ে ঐক থাকে । এভাবে পূর্ববাংলার স্বতন্ত্র বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশ ঘটে ।

৯. পাকিস্তানের পরবর্তী রাজনীতিতে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের প্রভাব : ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্ত ফ্রন্টের অভূতপূর্ব বিজয় পাকিস্তানের পরবর্তী রাজনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল। এ নির্বাচন শুধু যে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ছিল তাই নয়; বরং স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা যদিও বেশিদিন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে পারে নি । তবুও এ নির্বাচনে পূর্ববাংলার জনগণ যে রায় ঘোষণা করেছিল তা পরবর্তীকালে ‘৬৬-এর ৬ দফা ও ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচন এবং সর্বোপরি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতিধ্বনিতে উচ্চারিত হয়েছিল ।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে পূর্ববাংলার জনসাধারণের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার মূর্ত প্রতীক হিসেবে যুক্তফ্রন্টের আবির্ভাব ঘটেছিল । বিপুল জনসমর্থনে এ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে মুসলিম লীগের একাধিপত্যকে খর্ব করে । যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের ফলে বাঙালি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠার অনুপ্রেরণা এবং সেই লক্ষ্যে তাদের ঐক্যবোধ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় পরবর্তীতে মুক্তি ও স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষেত্র সুপ্রশস্ত হয় ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url